বেঁচে থাকলে এ বছর ১৫ জানুয়ারি মার্টিন লুথার কিংয়ের বয়স হতো ৮১। মৃত্যুর ৪২ বছর পর এখন যদি তিনি আমেরিকায় তাঁর স্বদেশে আসতেন, তাহলে কী অভাবিত পরিবর্তন হয়েছে, তা দেখে নিজেই বিস্মিত হতেন। ১৯২৯ সালে যে বছর মার্টিনের জন্ম, কম করে হলেও এক হাজার কালো মানুষ সাদাদের হাতে প্রকাশ্যে ফাঁসির দড়িতে খুন হয়। তখন কালো মানুষ সাদাদের সঙ্গে এক বাসে চড়তে পারত না, এক স্কুলে যেতে পারত না, রেস্তোরাঁয় সাদার পাশে কোনো টেবিলে বসার অধিকার তার ছিল না। সাদা-কালোয় বিয়ে ছিল আইনত অবৈধ। এখন সেই আমেরিকায় একজন কালো পিতা ও শ্বেত মাতার সন্তান বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট। কে ভাবতে পেরেছিল তাঁর মৃত্যুর মাত্র চার দশকে এমন আশ্চর্য পরিবর্তন অর্জিত হবে!
১৯৬৮ সালের ৪ এপ্রিল মেম্ফসিসে ঘাতকের গুলিতে নিহত হওয়ার সময় মার্টিন লুথার কিংয়ের বয়স ছিল মাত্র ৩৯। মৃত্যু অবশ্য মার্টিন লুথার কিংয়ের পিছু নেয় অনেক আগে থেকেই। যখন মাত্র ১৫ কি ১৬ বছর তাঁর বয়স, তখন কিং আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলেন। তাঁর প্রিয় মাতামহের অসুস্থতার সংবাদে তিনি এতটা বিচলিত হয়ে পড়েন যে নিজ গৃহের দোতলার জানালা গলে লাফিয়ে পড়েন তিনি। এরপর আরও অনেকবারই মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন। ১৯৫৬ সালে আলাবামার মনটোগোমেরিতে বর্ণগত বিভক্তির বিরুদ্ধে মার্চের সময় তাঁর বাড়ি বোমা মেরে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এই আলাবামাতেই ১৯৬৫ সালে নাগরিক অধিকারের দাবিতে মার্চের সময় পুনরায় আক্রান্ত হন তিনি। ১৯৬২ সালে তাঁর প্রতিষ্ঠিত সাউদার্ন ক্রিশ্চিয়ানস লিডারশিপ কাউন্সিলের বার্ষিক অধিবেশনে ভাষণদানকালে মার্কিন নািস দলের এক সদস্য দৌড়ে মঞ্চে এসে তাঁকে প্রবলভাবে আক্রমণ করেন। তাতে আহত হন কিং। তিনি রক্তাক্ত অবস্থায় ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে সহকর্মীদের নির্দেশ দেন, শ্বেতকায় লোকটিকে কেউ যেন পাল্টা আঘাত না করে। ১৯৫৮ সালে নিউইয়র্কের হারলেমে এবং ১৯৬৩ সালে ওয়াশিংটনে তাঁর ঐতিহাসিক পদযাত্রার সময়ও আক্রান্ত হন কিং। প্রতিবারই পাল্টা আঘাতের কথা না বলে তিনি বলেছেন ভালোবাসার কথা। ‘ঘৃণা নয়, আমার লক্ষ্য প্রেম’, বলেছিলেন কিং।
অথচ ভাগ্যের কী পরিহাস, ঘৃণার চিহ্ন বুকে নিয়ে গুলিতেই মারা গেলেন কিং। আর সেই মৃত্যুর ভেতর দিয়ে তিনি অমর হয়ে উঠলেন।
ঘাতকের গোপন কৃপাণ তাঁর জন্য অপেক্ষারত—এ কথা জেনেও অহিংস প্রতিরোধের মন্ত্র তিনি গ্রহণ করেছিলেন। এই মন্ত্র তিনি শিখেছিলেন যিশুখ্রিষ্ট ও মহাত্মা গান্ধীর কাছ থেকে। তাঁর পিতা ও পিতামহ উভয়েই ছিলেন আটলান্টার খ্যাতিমান ব্যাপ্টিস্ট ধর্মযাজক। অহিংসার বাণী তাঁদের কাছেই প্রথম শোনেন তিনি। পরে পেনসিলভানিয়ায় ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়নকালে এবং বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মশাস্ত্রে পিএইচডি ডিগ্রি গ্রহণকালে অহিংসার প্রতি তাঁর আস্থা আরও গভীরতর হয়। এ সময়ে গান্ধীর সত্যাগ্রহ আন্দোলন ঘনিষ্ঠভাবে অধ্যয়নের সুযোগ পান কিং। ১৯৫৬ সালে আলাবামায় বাসে সাদা ও কালোদের আলাদা বসার প্রচলিত নিয়মের বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন কিং। সেবারই প্রথম সত্যাগ্রহের অনুপ্রেরণায় তিনি পদযাত্রা, বয়কট ও অবস্থান ধর্মঘটের রণকৌশল প্রয়োগ করেন। শান্তিপূর্ণ সে আন্দোলনের ফলে আলাবামার বাস ভ্রমণে বর্ণগত বিভক্তি তুলে নেওয়া হয়। তাঁর আত্মজীবনীতে কিং লিখেছেন, ‘১৯৫৬ সালে বর্ণ বিভক্তির বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের শিক্ষা আমি গান্ধীর কাছ থেকেই পেয়েছিলাম।’ ১৯৫৯ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর আমন্ত্রণে সস্ত্রীক ভারতে আসেন কিং। সে সফরের কথা স্মরণ করে কিং পরে লিখেছেন, ‘এই সফরের ফলে আমি সুনিশ্চিত হই, গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের পথই সঠিক, সে পথই শ্রেষ্ঠ।’
কিন্তু মার্টিন লুথার কিংকে শুধু একজন গান্ধীবাদী অহিংস নাগরিক অধিকার নেতা হিসেবে পরিচিত করালে সত্যের অপলাপ হবে। শ্বেতপ্রধান আমেরিকা অবশ্য তাঁকে এভাবেই দেখতে চায়, কারণ তাঁকে একজন আধুনিক যিশু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করানো সম্ভব হলে শ্বেত-সভ্যতারই বিজয় ঘোষিত হয়। যে কথাটা কখনো স্বীকার করা হয় না তা হলো, ষাটের দশকের মাঝামাঝি কিংয়ের রাজনীতি বড় রকমের মোড় নেয়। রাজনৈতিক জীবনের প্রথম পর্বে কিং মুখ্যত সাদা ও কালোদের ভেতর সমানাধিকারের কথাই বলতেন। এমনকি ১৯৬৩ সালে ওয়াশিংটনে লাখ লাখ লোকের পদযাত্রা শেষে কিং যে ভাষণ দেন, তারও মূল সুর ছিল সাদা-কালো মানুষের সৌভ্রাতৃত্ব। আমরা বারবার শুনি কিংয়ের সে ভাষণের শুধু একটি কথা, ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম। সাদা ও কালো এই দেশে একসময় সমান অধিকার নিয়ে বাস করবে’—এই তাঁর স্বপ্ন। এমন স্বপ্নের ভেতর উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছুই দেখেনি আমেরিকার শ্বেত-সভ্যতা। ১৯৬২ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর আমেরিকার নতুন ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ঠিক এ কারণেই কিংয়ের প্রতি সাদর সম্ভাষণ জানান। কেনেডির মৃত্যুর পর লিন্ডন জনসন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করলে তিনিও কিংয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। জনসনের আমলে নাগরিক অধিকার সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আইন গৃহীত হয়। তাতে মার্টিন লুথার কিং দৃঢ় সমর্থন জানান।
কিন্তু সমস্যা বাধে ষাটের দশকের মাঝামাঝি, যখন কিং নাগরিক অধিকারের পাশাপাশি কৃষ্ণকায়দের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমানাধিকারের দাবি তোলেন। আমেরিকার বর্ণবাদী ব্যবস্থার গোড়ায় রয়েছে তাঁর বৈষম্যমূলক শ্রেণীব্যবস্থা। এ কথা প্রথমবারের মতো সরাসরি বলা শুরু করেন কিং ১৯৬৫ সালে। তত দিনে ভিয়েতনামে যুদ্ধ তেতে উঠেছে। সে যুদ্ধে অংশগ্রহণরত কৃষ্ণকায়দের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার অনুপাতে অনেক বেশি। ভিয়েতনাম যুদ্ধকে মাথায় রেখে কিং দাবি তোলেন, এই দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় কৃষ্ণকায় এবং অন্য সংখ্যালঘুদের পূর্ণ অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা না পাওয়া পর্যন্ত আমেরিকায় কখনোই সমানাধিকার অর্জিত হবে না। একই সময়ে ভিয়েতনামে মার্কিন সামরিক আগ্রাসনের তীব্র নিন্দায় মুখর হয়ে ওঠেন কিং। আর তার ফলেই জনসন প্রশাসনের সঙ্গে তাঁর মতভেদ ও দূরত্ব গড়ে ওঠে। যাঁকে আধুনিক যিশু বলে শ্বেত আমেরিকার উদারনৈতিক মহল সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, হঠাত্ তিনি হয়ে উঠলেন বিদ্রোহের মন্ত্রণাদাতা। কেনেডি তাঁকে একজন নতুন কার্ল মার্ক্স বলে ঠাট্টা করেছিলেন। জনসন সরোষে বলেছিলেন, ‘এই নিগ্রো লোকটা আর কী চায়? তাঁকে নাগরিক অধিকার আইন দিয়েছি, তাঁকে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কর্মসূচি দিয়েছি। আর কত তাঁকে দিতে হবে?’ ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদ করায় কিংয়ের জন্য হোয়াইট হাউসের দুয়ার বন্ধ হয়ে যায়।
তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শেষ পর্যায়ে কিং অহিংস আন্দোলন বিষয়ে তাঁর মনোভাবও কিছুটা বদলে ফেলেন। অহিংস আন্দোলনের অর্থ পড়ে পড়ে মার খাওয়া নয় অথবা কবে শ্বেত-শাসকের চৈতন্যে খ্রিষ্টীয় চেতনা সঞ্জীবিত হবে, তার জন্য নিষ্ক্রিয় অপেক্ষা নয়। ষাটের দশকেই অপর কৃষ্ণ অধিকার নেতা ম্যালকম এক্স সহিংস উপায়ে, প্রয়োজন হলে অস্ত্রের মাধ্যমে নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য কৃষ্ণকায়দের সংগঠিত করার কাজে হাত দেন। ম্যালকম মার্টিন লুথার কিংয়ের গান্ধীবাদী অহিংস আন্দোলনের তীব্র সমালোচক ছিলেন। কিংকে ‘নতুন আঙ্কল টম’ নামে অভিহিত করে ম্যালকম বলেছিলেন, শ্বেত আমেরিকার সবচেয়ে প্রিয় কালো মানুষ হচ্ছেন মার্টিন লুথার কিং। সম্ভবত ম্যালকমের কর্কশ আক্রমণের মুখে সংখ্যালঘুদের প্রতি শ্বেত আমেরিকার ‘টোকেনিজম’ উপলব্ধি করে কিং নিজেই ক্রমশ অধিকতর ‘র্যাডিকাল’ অবস্থান গ্রহণ শুরু করেন। নাগরিক অধিকারের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমানাধিকারের দাবি সে উপলব্ধিরই প্রকাশ। এর ফলে কিং যেন নিজেই তাঁর মৃত্যু পরোয়ানা লিখে দিলেন। তিন বছর পর ১৯৬৮ সালে সে পরোয়ানাই কার্যকর করা হলো।
তাঁর মৃত্যুর ৪০ বছর পর এখন পেছন ফিরে তাকিয়ে মনে হয়, বৃথা যায়নি মার্টিন লুথার কিংয়ের মৃত্যু। সাদা-কালোয় বৈষম্য এ দেশে এখনো বিস্তর, কিন্তু সে দূরত্ব ক্রমশ কমে আসছে। ১৯৬৮ সালে কিংয়ের মৃত্যুর সময়ে মার্কিন কংগ্রেসে কৃষ্ণকায় কংগ্রেস সদস্যের সংখ্যা ছিল মাত্র নয়। ২০০৮ সালে সে সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৩-এ। যা সবকিছু ছাপিয়ে যায় তা হলো, বারাক ওবামার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচন। ওবামা নিজে কিংকে তাঁর নায়ক বলে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর পড়ার ঘরে যে তিনটি ছবি তিনি সবচেয়ে যত্নের সঙ্গে বাঁধিয়ে রেখেছেন, তার একটি মার্টিন লুথার কিংয়ের। অপর দুজন হলেন আব্রাহাম লিংকন ও জন এফ কেনেডি।
0 comments:
Post a Comment